।। মহাকুম্ভে মহামেলা, লক্ষ-কোটি মানুষের সঙ্গমবেলা।।

বি কে ড.স্বপন রুদ্র : 2025-এর মহাকুম্ভ মেলা ইতিমধ্যেই সারা পৃথিবীতে সাড়া জাগিয়েছে যা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষকে তাদের অজ্ঞাতে কী যেন এক অজানা কারণে প্রয়াগরাজে টেনে এনেছে, সঙ্গে এদেশের লক্ষ লক্ষ সাধু-সন্ত, সন্ন্যাসী, নাগা-সন্ন্যাসী (যারা বিশেষভাবে শুদ্ধ ও ঈশ্বর সমর্পিত) এবং কোটি কোটি শ্রদ্ধালু তো আছেনই। ভারতবর্ষের সাধুসন্তের ধ্যান-সাধনা, মান-মর্যাদা, সভ্যতা-সত্যতা এদেশের সম্পদ যা দেশকে সময় সময় নানাভাবে গৌরবান্বিত করেছে। তবু বিদেশের অতিথি-অভ্যাগতদের বিশেষভাবে উল্লেখ করছি এই কারণে যে তারা কোথাও বিশেষ কিছুর সন্ধান না পেলে সেখানে ঘেঁষেন না। এদেশের কিছু ভিন্নমতের মানুষ যেমন এদেশের জ্ঞান-গুণ, শিক্ষা-দীক্ষা, আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতি অবলীলায় অবহেলা করে অন্য দেশের নিম্নমানের সত্য বা অসত্যের পিছনে দৌড়ে বেড়ান, ঠিক উল্টোপথে অসংখ্য বিদেশী তাদের প্রচুর ধনসম্পদ, বড়সড় পদ-পোষ্ট, চাকরী-বাকরী সব ছেড়েছুড়ে অনেকদিন ধরে অনেকের হাত ধরে (ইসকন, শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম, শঙ্করাচার্জের বিভিন্ন মঠ-মিশন ও আখাড়া, ব্রহ্মাকুমারীজ প্রভৃতি) এই দেশে আসতে শুরু করেছেন (স্বামীজীর হাত ধরে প্রথম, তারপর শ্রীল প্রভুপাদ প্রভৃতি) এবং আজ আরো বেশী বেশী করে আসছেন, বোধ হয় 144 বছর পরের এই মহাকুম্ভে যা আরো ভালোভাবে প্রস্ফুটিত হল। প্রয়াগের ত্রিবেণী সঙ্গমে বা আরো কিছু জায়গায় (যেমন হরিদ্বার, নাসিক, উজ্জয়িনী ইত্যাদি) কুম্ভের মেলা বসে–প্রতি 3 বছর পর হলে তা কুম্ভ, 6 বছর পরে হলে অর্ধ কুম্ভ, প্রতি 12 বছর পর হলে তা পূর্ণ কুম্ভ মেলার স্বীকৃতি পায়। এই 12 বছর অন্তর পূর্ণ কুম্ভের কারণ পঞ্জিকা মতে গুরু-গ্রহ বৃহস্পতির বার্ষিক গতির (পৃথিবীর 12 বছরে বৃহস্পতি একবার সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে) সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বলে ধরা হয়, আর মহাকুম্ভ বারো বার বারো বছর পর (12X12) একবার অতি দূর্লভ মুহূর্তে সংঘটিত হয়। আমরা এর আগের মহাকুম্ভের (1881-র) ব্যাপারে মনে হয় বেশী কেউ তেমন কিছু জানি না কারণ আজকের কেউ সেদিনের সেখানে ছিলাম না, তবে হয়তো তা কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই লিপিবদ্ধ আছে, খুঁজে বের করলে অবশ্যই পাওয়া যাবে ইতিহাসের পাতায় যেভাবে আমরা প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় ইতিহাস পড়াশুনো করি! তবে মহাকুম্ভ বারে বারেই হয়েছে কারণ বহতা নদী (মানে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী) সেই আছে, মহাকুম্ভের সঙ্গমস্থলও একই আছে আর সেখানে মানুষের সঙ্গমে মহাকুম্ভ হবে না, তা কি হয়? বরং আগের আগের মহাকুম্ভে ছিল প্রাচীন ভারত যা আরো গৌরবান্বিত, যদিও নদীর জলধারার মতোই মানুষেরও জন্ম-জন্মান্তরে শরীর পরিবর্তিত হয়েছে এবং নতুন নতুন আত্মাও পরমধাম থেকে নেমে এসে নতুন শরীর ধারণ করে চলেছে। এখানে জন্ম-জন্মান্তরের ব্যাপারটা একটু বুঝে নিই, তা হল–কোন আত্মা পরমধাম থেকে পৃথিবীতে একবার নেমে আসার পর থেকে সে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে থেকে এখানেই কোথাও কোন পরিবারে নারী বা পুরুষ শরীরে ড্রামা-নির্দিষ্ট নিজস্ব পার্ট প্লে করতে থাকে, একবার নামলে আবার সেই 5000 বছর পর বাড়ী (নির্বাণধাম) ফেরা। গীতাতেও আমরা চক্রবৎ জন্ম-জন্মান্তরের কথা পড়েছি।
সে যাই হোক, এই মহাকুম্ভের বিস্তৃত পরিসরে সবরকমের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক প্রদর্শনী, আলাপ-আলোচনা, প্রসঙ্গ-প্রবচন সবই যেমন আছে, তেমনই সর্বাগ্রে আছে মহাকুম্ভে লক্ষ-লক্ষ সাধু-সন্ত বা ভাব-বিহ্বল শ্রদ্ধালুর ঊষালগ্নে বা প্রাতে পূণ্য স্নান, মহাকুম্ভস্থলের খবর উদ্ধৃত করে বলা যায় যে এই 14-ই জানুয়ারি থেকে আজ 27 জানুয়ারি সকাল অবধি 14 দিনে প্রায় 12 কোটির বেশী মানুষ মহাকুম্ভে মহাস্নান সেরে ফেলেছেন, 26-শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংখ্যাটা 40 কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। মহাকুম্ভের গুরুত্ব এই কারণে অপরিসীম যে এই সময় ওখানে এক বিশেষ মহাজাগতিক তরঙ্গ কাজ করছে এবং যার সঙ্গে মানব মনের সংযোগ আছে, মানবাত্মার শুদ্ধ ভাইব্রেশন আছে এবং অসংখ্য আত্মার একত্র সমাবেশে এক বিশেষ দিব্য ও ভব্য পরিবেশ তৈরী হয়েছে। প্রয়াগরাজে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন সনাতনী আখড়া, ভিন্ন ভিন্ন মঠ-মিশন থেকে আগত সাধুসন্তের ঊষালগ্নে স্নান ও তাদের দর্শন প্রভৃতি নিয়মিত চলছে।তার সঙ্গে সেখানে ব্রহ্মাকুমারীজের ভিন্ন ভিন্ন প্রদর্শনী যেমন সত্যযুগী দুনিয়া, ঈশ্বরীয় জ্ঞান, রাজযোগ মেডিটেশন, মাইন্ড-স্পা, যৌগিক কৃষি, নেশামুক্তি ও বিকারমুক্তির উপায় এবং দৈবী জ্ঞান ও গুণের ধারণায় কিভাবে নর থেকে নারায়ণ ও নারী থেকে লক্ষ্মী হওয়া যায় তার শিক্ষা প্রভৃতি। এখন এমনিতেই সঙ্গমযুগ চলছে আত্মা-পরমাত্মার মিলনে যা নদী-সাগর সঙ্গমে (গঙ্গাসাগর) পুন্য স্নানের মাধ্যমেও মানুষ অজান্তেই পালন করেন। যদিও আমরা জানি যে গঙ্গা স্নানে পাপ ধোয়া যায় না বা বিকর্ম বিনাশ হয় না, পাপ নষ্ট করার একমাত্র পদ্ধতি হল সর্বদা পরমাত্মার স্মরণে থাকা মহাকুম্ভের পবিত্র ভূমিতে এবং সেখানের বিশেষ আধ্যাত্মিক পরিবেশে যা বেশী মাত্রায় সম্ভব। এখন মা গঙ্গা-যমুনা মহাজাগতিক কারণে চার্জড, প্রকৃতি-পরিবেশ ও আবহমন্ডলও চার্জড, আর এক্ষণে সাধু-সন্ত (যারা তন-মন-ধন সব সঁপে দিয়ে নিরন্তর তপস্যাতেই রত থাকেন), গুণীজন ও নর-নারায়ণের সম্মিলিত সহাবস্থানে মহাকুম্ভ এখন এক শক্তিস্থলে পরিণত যেখান থেকে আমরা প্রত্যেকেই প্রতক্ষ্যে বা পরোক্ষে সেই শক্তি ধরে নিতে পারি।